রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর পাওয়া যায় তাঁর গানের মাধ্যমে- যেগুলি আমাদের কাছে রবীন্দ্রসংগীত রূপে পরিচিত । কবিগুরুর গানে বিভিন্ন চেতনা এবং অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে।
রবি ঠাকুর নিজে তাঁর লেখা সমস্ত গানের শ্রেণীবিভাজন করেছিলেন এবং বিস্তারিত ভাবে গীতবিতান বইতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
রবীন্দ্রসংগীত মূলত ছয়টি শ্রেণী বা “পর্যায়”-এ বিভক্ত| এই ছয়টি পর্যায় হলো- পূজা, প্রকৃতি, প্রেম, স্বদেশ, বিচিত্র, ও আনুষ্ঠানিক পর্যায়।
পূজা পর্যায়
পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতগুলি আরাধনা এবং প্রার্থনার উদ্যেশে রচিত। তাঁর রচিত পূজা পর্যায়ের সংগীতগুলি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কিছু পূজা পর্যায়ের সংগীত প্রেম এবং প্রেমাস্পদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ভাবের উপরে ভিত্তি করে রচিত। কবিগুরু মোট ছয়শো সতেরোটি পূজা পর্যায়ের সংগীত রচনা করে ছিলেন।
“শুধু তোমার বাণী নয় হে সখা “এবং “কবে আমি বাহির হলেম এই পর্যায়ের অন্তর্গত।
পূজা পর্যায় একুশটি উপ-পর্যায়ে বিভক্ত-
- প্রার্থনা
- গান
- জাগরণ
- বন্ধু
- বিরহ
- সাধনা বা সংকল্প
- দুঃখ
- আশ্বাস
- আত্মবন্ধন
- উৎসব
- আনন্দ
- নিঃসহায়
- সাধক
- অন্তর্মুখী
- বিবিধ
- বিশ্ব
- বাউল
- পথ
- সুন্দর
- শেষ
- পরিণয়
প্রকৃতি পর্যায়
যে সকল রবীন্দ্রসংগীত প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ এবং বিভিন্ন প্রকার ঋতুর রূপের বর্ণনা করে সেগুলিকে প্রকীর্তি পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই জন্য অনেক সময় এই পর্যায়কে ঋতু পর্যায় বলেও অভিহিত করা হয়।
“এস হে বৈশাখ” , “শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি” ইত্যাদি রবীন্দ্রসংগীত এই পর্যায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
কবিগুরু প্রকৃতি পর্যায়কে ঋতুচক্র অনুসারে সাতটি উপ পর্যায়ে ভাগ করেছেন –
- সাধারণ – উনিশটি গান
- গ্রীষ্ম – ষোলোটি গান
- বর্ষা – একশো পনেরোটি গান
- শরৎ – তিরিশটি গান
- হেমন্ত – পাঁচটি গান
- শীত – বারোটিগান
- বসন্ত – নব্বইটি গান
প্রেম পর্যায়
কবিগুরুর প্রেম পর্যায়ের সংগীতগুলি স্বকীয় ভাব বহন করে। এই রবীন্দ্রসংগীতগুলি প্রেমিক এবং প্রেমিকার প্রেমের অন্তরঙ্গতার পরিচয় বহন করে না। পরিবর্তে, কবিগুরুর প্রেম পর্যায়ের সংগীতগুলি শাশ্বত এবং পবিত্র প্রেম বা platonic love এর বর্ণনা দিয়ে থাকে। কিছু কিছু প্রেম পর্যায়ের সংগীতে দুই বন্ধুর পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসার আভাষ পাওয়া যায়। কবিগুরু মোট তিনশো পঁচান্নব্বইটি সংগীত এই পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
“তোমায় গান শোনাবো” এবং “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা ” প্রেম পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত।
এটি দুটি উপ-পর্যায়ে বিভক্ত। সেগুলি হলো-
- গান- সাতাশটি গান
- প্রেম বৈচিত্র- তিনশো আটষট্টি-টি সংগীত
স্বদেশ পর্যায়
কবিগুরু অনেকগুলি গান ভারতবাসীর মধ্যে দেশপ্রেমের ভাবনা এবং উদ্দীপনা জাগরণের জন্য লিখেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা এই সব গানে দেশপ্রেমের ভাবনা সুস্পষ্ট। গীতবিতানে মোট ছেচল্লিশটি গান স্বদেশ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
উদাহরণ : “একলা চলো রে “, “এবার তোর মরা গাঙে” ইত্যাদি
বিচিত্র পর্যায়
কবিগুরু তার সংগীতের মাধ্যমে মানব মনের বিভিন্ন অনুভূতিকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। এই রকম বিচিত্রভাবের উপরে লিখিত মোট একশো চল্লিশটি সংগীতকে তিনি বিচিত্র পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
উদাহরণ: মম চিত্তে নীতি নৃত্যে
নাই ভয় নাই
ওঠো রে মলিন মুখ
যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ
আনুষ্ঠানিক পর্যায়
সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন বিবাহ, জন্মদিন, এবং স্মরণসভায় গাওয়ার জন্য কবিগুরু মোট একুশটি সংগীত রচনা করেছিলেন। এগুলি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
কয়েকটি উদাহরণ-
মরুবিজয়ের কেতন
অগ্নিশিখা এস এস
শুভদিনে এসেছে দোঁহে
উল্লেখযোগ্যভাবে কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত যেমন “উজ্জ্বল করো হে আজি” পূজা পর্যায় এবং আনুষ্ঠানিক পর্যায় উভয় শ্রেণীতেই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
উপরোক্ত ছয়টি মূল পর্যায় ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীতে আরো কিছু বিশেষ শ্রেণীবিভাগ দেখা যাযা। এইগুলি হলো-
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য
গীতিনাট্য হলো গানের উপর ভিত্তি করে রচিত নাট। এরকম নাটকে গানের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। কবিগুরুর রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গীতিনাট্য হলো বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা, কাল মৃগয়া ।
নৃত্যনাট্য হলো বিশেষ প্রকারের নাট। এই প্রকার নাটকে গান এবং নৃত্যের মাধ্যমে গল্প এবং চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শ্যামা, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা হলো কবিগুরুর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত নৃত্যনাট্য।
এই গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের সংগীতগুলিকে কবিগুরু কিছু ক্ষেত্রে অন্য পর্যায়েও লিপিবদ্ধ করেছেন।
ভানু সিংহের পদাবলী
নিজের লেখক জীবনের শুরুতে কবিগুরু ভানু সিংহ ছদ্মনামে কিছু বিশেষ শ্রেণীর পদাবলী রচনা করেছিলেন। এই পদাবলীর সংগীতগুলির মধ্যে ভারতীয় রাগসঙ্গীত এবং ব্রজবুলি ভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মোট কুড়িটি সংগীত ভানু সিংহের পদাবলীর অন্তর্গত।
উদাহরণ:
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান
সাঙ্গনগগনে ঘোর ঘনঘটা
নাট্যগীতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু বিশেষ সংগীত(প্রায় একশো তেত্রিশটি গান)রচনা করেছিলেন যেগুলি নাটক হলেও সংগীতের আকারে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
যেমন- চিরিতন হরতন ইস্কাবন (তাসের দেশ)
সখী আর কত দিন সুখবোনে
বুঝেছি বুঝেছি সখা